Saturday, March 11, 2023

একটি প্রাক শীতের রাত ও ‘তিমির তীর্থ’


 শীতের রাতগুলি আসার কয়েকদিন আগে এক বন্ধুর সাথে রাতে হেঁটে ফিরছিলাম খগেশ্বর রোড দিয়ে। নিতান্ত ঘরোয়া সাজে অধ্যাপক সুশান্ত কর তাঁর আবাসনের নিচে এসে নিজের গাড়ি থেকে কিছু কাগজপত্র নিয়ে যাচ্ছিলেন। আমি নয়, তিনিই আমাকে হঠাৎ আধো অন্ধকারে আবিষ্কার করলেন আর একপ্রকার টেনে নিয়ে গেলেন ওর ভদ্রাসনে। তিনি ঐখানে না থাকলে আমি যে আবারও তার বাড়িতে যাওয়া এড়িয়ে যেতাম তা যেমন তিনি জানতেন, আমিও! সেই লজ্জা লুকোবার চেষ্টায় কান পর্যন্ত হাসি তুলে তাঁর বাড়িতে ঢুকে দেয়াল ঘড়িতে দেখি রাত দশটা। এমন রাতে ‘তিমিরতীর্থ’ হাতে তুলে দেবার মতো উপযুক্ত বই বটে। চিন্তাবিদ ও কথাশিল্পী হোমেন বরগোহাঞির এই উপন্যাস অনুবাদ করেছেন সুশান্ত কর। অসমীয়া সাহিত্যের মনিমুক্তা থেকে বাঙালি পাঠক যাতে ব্রাত্য থেকে না যান সেই কথা মাথায় রেখে সুশান্ত ইতিমধ্যে আমাদের কিছু জরুরী অনুবাদ উপহার দিয়েছেন । অসমের সচেতন বাঙালি পাঠক মাত্রেই তা জানেন। অরূপা পটঙ্গীয়া কলিতার ‘ফেলানি’র মতো দীর্ঘ উপন্যাস অনুবাদ করে সুশান্ত আমাদের এক বেদনার্ত দলিলের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন । গুয়াহাটির বিকি পাবলিশার্স বইটি ছেপেছিল।

বর্তমানের যে বইটি সুশান্ত আমাকে দিলেন সেটি অসমের সকল সংগ্রামী, বিপ্লবী বা আপোষহীন যত ব্যক্তিত্ব আছেন তাঁদের পড়া উচিত। এই আলোচনা যদিও হোমেন বরগোহাঞির সাহিত্যের নয়, কিন্তু সেসবের সবগুলি কালজয়ী না হলেও জনসাধারণের মানসিক ও বৌদ্ধিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য। আমি বলছিলাম অনুবাদকর্মের কথা। মূল গল্পটিকে অনুবাদ করার সময় সুশান্ত স্যার এক অদ্ভুত মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। উপন্যাসে গল্পের খাতিরে মার্ক্সতত্বের বিশ্লেষণ এসেছে। এসেছে কাছাকাছি সম্পর্কগুলির মধ্যে টানাপোড়েন, রাজনৈতিক অস্থিরতার ইঙ্গিত, ইত্যাদির সঙ্গে ক্রমাগত মানসিক যুদ্ধ করতে থাকা কিছু মানুষের ঘাত প্রতিঘাতের কথা। নতুন বা অল্পবয়স্ক পাঠক যাতে বিভ্রান্ত না হন সেসব দিক নিয়ে ভেবেই সুশান্ত সহজ এবং উপযুক্ত বাংলা শব্দচয়ন করে গল্পটিকে বুনে গেছেন, সমূহ নতুন পাঠকদের জন্য প্রাঞ্জল ও বোধগম্য করে। এখানেই এই বইটির অনুবাদ নজর কেড়ে নেয়। এবং অবসম্ভাবীইভাবেই অনুবাদ হয়ে উঠে অনুসৃষ্টি ।যারা ‘তিমির তীর্থ’ পড়েননি তারা এটি পড়ুন এবং দেখুন ১৯৭৫ সালে প্রথম প্রকাশিত এই উপন্যাসের উপজীব্য কেমন আজও প্রাসঙ্গিক। ছোট এই বইটির প্রচ্ছদ কল্পনা আমাদের সুহৃদ রেখাচিত্রশিল্পী ত্রিদিব দত্তর। তিনি গল্পের প্রতি সুবিচার করে এই প্রচ্ছদ নির্মাণ করেছেন, যদিও পাঠকহিসেবে কভারে লাল রঙের উল্লেখ সামান্য থাকলে ভাল হতে বলে আমাদের মনে হয়েছে।
তিনসুকিয়া কলেজ এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে। বাংলা লেখালেখির প্রকাশক বা ব্যবসা অসমে দুর্লভ এ কথা সর্বজনবিদিত। সেই সময় দুটি বাংলা বই (‘অথবা’ শিরোনামে হেমাঙ্গ কুমার দত্তর অসমীয়া কবিতার বাংলা অনুবাদকর্ম যা করেছেন আবার ঐ অধ্যাপক সুশান্ত কর) ছেপে কলেজ কর্তৃপক্ষ নিজেদের দায়িত্বশীলতার অসাধারণ উপমা তুলে ধরেছেন। সাম্প্রদায়িক সদ্ভাবনা, বিভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির সহবস্থানের ক্ষেত্রে এটি এক উজ্জল দৃষ্টান্ত হয়ে রইল। দি আসাম কম্পিউটারস মুদ্রণ ও বাঁধাই করেছে সুদৃশ্য ও প্রায় নির্ভুল।
অনুবাদকের সাথে যোগাযোগ ছাড়া বইটি পড়ার আর কোনো উপায় আমার জানা নেই।
যেহেতু সেদিন রাত দশটা বেজে গিয়েছিল তাই অফার করার পরেও চা আর বৌদির হাতের বিখ্যাত ডিমের অমলেট আমাকে প্রত্যাখ্যান করে উঠতে হয়েছিল এবং সেসব কিছুর ক্ষতিপূরণ ‘তিমির তীর্থ’র নিবিড় পাঠ আমাকে পুষিয়েছে!

No comments:

Post a Comment